জামায়াত ছাড়ার পথ খুঁজছে বিএনপি
► হিসাব-নিকাশ চূড়ান্ত পর্যায়ে
► ঘুরপাক খাচ্ছে নানা ফর্মুলা
► খালেদা জিয়ার বার্তার অপেক্ষা
সিডি ডেস্কঃ
২০ দলীয় জোটের দ্বিতীয় বৃহৎ দল জামায়াতকে নিয়ে বিএনপির হিসাব-নিকাশ এখন প্রায় চূড়ান্ত পর্যায়ে বলে জানা গেছে। বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ের বেশির ভাগ নেতা মনে করেন, জামায়াতকে নিয়ে আর সামনে অগ্রসর হওয়া যাবে না। তাই কোন প্রক্রিয়ায় দলটিকে জোট থেকে বিদায় করা হবে, তা নিয়ে বিএনপির বিভিন্ন পর্যায়ে আলোচনা চলছে। কেউ কেউ এ জন্য নানা ফর্মুলার কথাও বলছেন। বিএনপির কয়েকটি সূত্রে জানা গেছে, জামায়াতকে বিদায় করার একটি ফর্মুলা হচ্ছে, ২০ দলীয় জোট এবং জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট—দুটিই ভেঙে দিয়ে নতুন করে বৃহত্তর জোট গঠন এবং জামায়াতকে তার বাইরে রাখা। অর্থাৎ এককভাবে জামায়াতকে জোটের বাইরে ঠেলে না দেওয়া। বিএনপির মতে, এমন ফর্মুলায় জামায়াতকে বাদ দেওয়া হলে কিছু বামপন্থী দলকে বৃহত্তর জোটে সম্পৃক্ত করা সহজ হবে। বামপন্থী দলগুলোকে কাছে টানতে গেলে শুরুতেই তারা জামায়াত প্রসঙ্গ তুলছে বলে জানা যায়। একটি সূত্রের দাবি, জামায়াতের বিষয়টি নিষ্পত্তির জন্য বিএনপিপন্থী সুধীসমাজের পাশাপাশি দলের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের পরামর্শের সূত্র ধরে লন্ডনে অবস্থানরত দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানও এখন নড়েচড়ে বসেছেন। তিনি দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের কাছ থেকে এ বিষয়ে মতামত নিচ্ছেন। তবে এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য বিএনপি চেয়ারপারসন কারাবন্দি খালেদা জিয়ার মতামত নেওয়ারও চেষ্টা চলছে। তাঁর কাছ থেকে কোনো বার্তা পাওয়া গেলে সমঝোতার ভিত্তিতেই জোটের বাইরে রাখা হবে ২০ বছরের রাজনৈতিক মিত্র জামায়াতকে। ১৯৯৯ সালে খালেদা জিয়ার উদ্যোগে বিএনপি, জাতীয় পার্টি, জামায়াত ও ইসলামী ঐক্যজোটের সমন্বয়ে চারদলীয় জোট গঠিত হয়েছিল, যা পরে ২০ দলীয় জোটে রূপ লাভ করে। ২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট ক্ষমতায় এলেও এরপর এক যুগেরও বেশি সময় ধরে ক্ষমতার বাইরে রয়েছে বিএনপি। বলা হচ্ছে, জামায়াত সঙ্গে থাকায় প্রধান প্রতিবেশী দেশের পাশাপাশি পশ্চিমা দেশগুলোর সমর্থন না পাওয়ায় বিএনপি দুরবস্থায় পড়েছে। এদিকে জামায়াত ও বিএনপির গাঁটছড়া আগের মতো দৃশ্যমান নয়। সর্বশেষ গত ২৩ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত ২০ দলীয় জোটের বৈঠকে জামায়াত অংশ নেয়নি। এর আগে ২৮ ডিসেম্বরের বৈঠকেও যায়নি দলটি। ওই বৈঠকে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিএনপি মনোনীত প্রার্থীদের প্রতি শরিকরা সমর্থন জানিয়েছিল বলে দাবি করেছিলেন জোটের সমন্বয়ক নজরুল ইসলাম খান। কিন্তু বিএনপির প্রার্থীরা কালের কণ্ঠকে জানান, কোনো এলাকায়ই তাঁদের প্রচারে জামায়াতের নেতাকর্মীদের দেখা যায়নি। এ বিষয়ে ২০ দলীয় জোটের সমন্বয়ক নজরুল ইসলাম খান জানান, জামায়াতের সংশ্লিষ্ট নেতারা বাইরে থাকায় বৈঠকে আসতে পারেননি। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, নির্বাচনী প্রচার কমিটিতে শরিক কোনো দলকে রাখা হয়নি। জামায়াতকেও রাখা হয়নি। তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্যসহ কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা কালের কণ্ঠকে বলেন, জামায়াতকে বিএনপির সঙ্গে ওই কমিটিতে রাখার প্রস্তাব থাকলেও শীর্ষ নেতৃত্ব তাতে সম্মত হয়নি। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘জামায়াত আগের মতো আর তৎপর নেই, সেটি একদিকে এখন দৃশ্যমান। তা ছাড়া তাদের আলাদা কোনো রাজনীতি থাকতে পারে।’ তিনি বলেন, ‘জামায়াতের অস্তিত্ব বাঁচাতে হবে। বর্তমান সরকারের সময় বিএনপিকে সমর্থন করা তাদের জন্য কঠিন।’ বিএনপির স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘জামায়াতকে আমরা ডাকিনি, এ জন্য কিছু লোক খুশি হবে। আবার আওয়ামী লীগ না ডাকলে জামায়াত খুশি হবে।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘প্রচার কমিটিতে জামায়াতকে কেন সম্পৃক্ত করা হয়নি আমার জানা নেই। তবে এটা ঠিক যে জামায়াত ভোটকেন্দ্রে গেলে তাদের মার খাওয়ার সম্ভাবনা কম। কারণ তাদের কেউ চেনে না। পরিচিত বিএনপি গেলে মার বেশি খাবে।’ জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরোয়ার কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘সংশ্লিষ্ট নেতারা ঢাকার বাইরে সফরে থাকায় বৈঠকে যেতে পারেননি।’ তিনি বলেন, ‘ভবিষ্যতে আমরা যাব। এখানে অন্য কোনো কারণ নেই।’ এদিকে বিএনপিও ঢাকার দুই সিটি নির্বাচনে জামায়াত থেকে দূরে থাকার কৌশল নিয়েছে। গত ৮ জানুয়ারি ড. কামাল হোসেনসহ জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নেতাদের কাছে বিএনপির দুই মেয়র পদপ্রার্থী সমর্থন চাইতে গেলেও জামায়াতের কারো কাছে তাঁরা যাননি। শুধু তা-ই নয়, প্রচার কমিটিতেও জামায়াতকে সম্পৃক্ত করা হয়নি বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্বের সিদ্ধান্তের কারণেই। নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিএনপির স্থায়ী কমিটির একাধিক সদস্য জানান, জোটের সমন্বয়ক নজরুল ইসলাম খান এ বিষয়ে আগ্রহী ছিলেন। কিন্তু শীর্ষ নেতৃত্ব রাজি না হওয়ায় জামায়াতকে রাখা হয়নি। দলীয় সূত্রে জানা যায়, তারেক রহমানের নির্দেশনায় ও নজরুল ইসলাম খানের উদ্যোগে মাঝেমধ্যে ২০ দলীয় জোটের বৈঠক ডাকা হয়। তবে বিএনপির বেশির ভাগ জ্যেষ্ঠ নেতা ওই বৈঠক পছন্দ করেন না। ওই নেতাদের মতে, আন্দালিব রহমান পার্থর নেতৃত্বাধীন বিজেপি বেরিয়ে যাওয়ায় এবং অলি আহমদ ও কল্যাণ পার্টির সমন্বয়ে পৃথক মঞ্চ গঠিত হওয়ায় ওই জোটের কার্যকারিতা অনেক কমে গেছে। তাই শুধু জামায়াতকে তাঁরা গুরুত্ব দিতে রাজি নন। বিষয়টি বিভিন্ন মহলকে দিয়ে তারেককে বোঝানো হয়েছে। ২০ দলীয় জোটের প্রধান শরিক জামায়াতে ইসলামীকে নিয়ে বিএনপির মধ্যে প্রশ্ন তৈরি হয়েছিল ২০১৮ সালের শুরুর দিকেই। দলটির অভ্যন্তরীণ আলোচনায় তখনই অনেকে মত প্রকাশ করেন যে নির্বাচনের আগে তাদের সঙ্গে ঐক্য না ভাঙলে ভারতসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থন মিলবে না। কিন্তু ওই বছরের ফেব্রুয়ারিতে খালেদা জিয়া কারাগারে চলে যাওয়ার পাশাপাশি শীর্ষ নেতৃত্বের সিদ্ধান্তহীনতা এবং নানা সমীকরণে দলের বড় অংশের ওই উদ্যোগ শেষ পর্যন্ত কার্যকর হয়নি। কিন্তু এরই মধ্যে ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর আরো একটি নির্বাচন হয়ে গেছে। আর ওই নির্বাচনেও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থন পাওয়া যায়নি বলেই বিএনপি আরো দুরবস্থায় পড়েছে বলে দলটি মনে করে। ফলে বিএনপির এখনকার সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের উপলব্ধি হলো—জামায়াতকে না ছাড়া পর্যন্ত ক্ষমতার রাজনীতিতে আলোর মুখ দেখা যাবে না। আর অনুকূল পরিস্থিতিও তৈরি হবে না। ফলে কী প্রক্রিয়ায় দলটিকে জোট থেকে বিদায় করা যায়, তা নিয়ে নানামুখী আলোচনা চলছে।
Leave a Reply